রফিকুল ইসলাম।
(ওনারা ২৪ জনআমার সহকর্মী। কনস্টবল)
চাকরীর বয়স আমার চাকরীর দ্বিগুনেরও বেশী। এক পদে টানা ৪০ বছর কাজ করে গেছেন। এরকমই এক দিনে ,কোন এক সকালে,কোন এক জেলার পুলিশ লাইনে আরো অনেকের সাথে এসেছিলেন তারাও, মাপজোক, ওজন, লাফঝাপ, মাঠের মধ্যে ঘাড়গুজে বসে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশের খাকি পোশাক গায়ে জড়িয়ে দূরন্ত কৈশোরকে পেছনে ফেলে হয়ে গেলেন পুলিশ সদস্য।
দীর্ঘ চ ল্লি শ বছর কাজ করে গেছেন, হাতে লাঠি, ঘাড়ে রাইফেল নিয়ে, সময়ের পরিক্রমায় হাতের লাঠির বদলে উঠেছে আধুনিক ব্যাটন,ঘাড়ের সাথে সিলিংয়ে ঝোলা থ্রিনটথ্রির জায়গা দখল করেছে চাইনিজ রাইফেল অথচ ইউনিফরমের শোল্ডারের জায়গাটা খালিই রয়ে গেছে, কোন Rank ব্যাজ তার শোভাবর্ধন করেনি, হয়ত প্রতি তিন চার বছর পর পর ব্রেস নম্বর( কনস্টবল নমবর পিতলের চাকতিতে লেখা থাকত একসময়) টা বদলেছে।
দুরন্ত যৌবনে টগবগে ঘোড়ার মত ছুটে চলা সে যুবক আজ চাকরীর শেষ দিনে এসে ভারাক্রান্ত, অনেকে অসুস্থ; জীবনের বেশীরভাগ সময় পরিবার থেকে দূরে থেকে, সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ডিউটি শেষে পুলিশ লাইন ব্যারাক বা থানার খাটিয়ায় শুয়ে হয়ত ভেবেছেন দুরের কোন এক জেলায় রেখে আসা স্ত্রী , সন্তানদের মুখ; রাতের পর রাত কখনও জনবহুল,কখনও নির্জন রাস্তায় চেকপোস্ট করতে করতে ক্লান্ত চোখে হয়ত ভেসে উঠেছে প্রিয়মুখ গুলো; জানিনা তারা ৪০ বছরে কতটা ঈদ নিজের পরিবারের সাথে করতে পেরেছেন? তবে নিশ্চিত জানি ঈদের দিনের নামাজটাও অনেকেরই পরার সুযোগ হয়নি, দুপুরে পুলিশ লাইন বা থানার মেসে সহকর্মীদের সাথে ঈদ উদযাপন করেছেন আর চোখের পানি নীরবে মুছে ঈদের খাবারটা খেয়েছেন।
পুলিশের চাকরীতে অধিকাংশ কনস্টবল নীরবেই চলে যান চাকরীর শেষ কর্মদিবসে, রিজার্ভ অফিস থেকে একটি সিসি নিয়ে, ৪০ বছর ধরে শরীরে জড়িয়ে থাকা ইউনিফরমটা জমা দেয়ার অনুভূতিটা কেমন তা আমি চোখ বুজলেই অনুভব করতে পারি, আমি নিজেও যে এই ইউনিফরমকে খুব ভালবাসি।৪০ বছর যিনি পুরো বিভাগকে, দেশকে নিজের সর্বস্ব উজার করে, চরম ত্যাগ শিকার করে সেবা দিয়ে গেলেন, শেষ দিন তাকে কদাচিত কেউ বলে আপনার ৪০ বছরের সেবার জন্য ধন্যবাদ।
গত দুই এক বছরে আমাদের সহকর্মীরা জেলা পর্যায়ে পুলিশ সংস্কৃতির বড় একটি পরিবর্তন এনেছেন, প্রায় প্রতি জেলার পুলিশ সুপারগন কনস্টবলদের বিদায়বেলা তাদেরকে সুসজ্জিত গাড়ীতে বাড়ী পাঠাচ্ছেন; আজ পাবনা জেলা পুলিশের ৩ জন এএসআই ২৪ জন কনস্টবলকে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়।
বিদায়বেলা তাদেরকে ‘আপনার সার্ভিসের জন্য ধন্যবাদ’ বলতে পারাটা আমার জন্যও গর্বের ও আনন্দের ।