বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে আমরা সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই এককভাবে নিরাপদ নই। বিশেষ কোনো অঞ্চল, জাতিগোষ্ঠী কিংবা পরাক্রমশালী দেশ- কেউ করোনার আঘাত থেকে রেহাই পায়নি। ধনী-দরিদ্র, উন্নত-অনুন্নত সবাই করোনা মহামারিতে সমানভাবে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বে করোনা মহামারিতে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে চার মিলিয়নের অধিক মানুষ। করোনার শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত মানুষের কাছে ভিড়ত না আপনজন। করোনা আক্রান্ত মৃত মাকে জঙ্গলে ফেলে ছেলে পালিয়ে গিয়েছিল- এমন খবরও আমাদের দেখতে হয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলেও মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে সে ভয়াল পরিস্থিতি জয় করে মানবিকতার হাজারো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে- সামাজিক দূরত্ব মানে সম্পর্কের দূরত্ব নয়; বন্ধনের দূরত্ব নয়।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণের চলাচল এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ চলমান থাকাকালীন গত সাত দিনে দেশে কভিডে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ২৩৫। গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ২৬৪ জন এই ভাইরাল রোগে মারা গেছে। প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে কভিড সংক্রমণের সবচেয়ে ভয়াবহ সময় প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ এবং গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১২ হাজার ৭৪৪ জন নতুন কভিড রোগী শনাক্তের তথ্য তারই বহিঃপ্রকাশ। কভিড-১৯-এর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের প্রথমদিকে ভারত খুব নাজুক অবস্থায় ছিল। বিশেষ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে দিল্লির পরিস্থিতি ছিল বেশ হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু সময়োপযোগী কিছু কঠোর পদক্ষেপের ফলে তারা সংক্রমণের হার গত ৩১ মে’র মধ্যে মাত্র ১ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। গৃহীত এসব পদক্ষেপের বিশ্নেষণপ্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য। কেননা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, মানুষের অভ্যাসগত আচরণ, সামাজিক কার্যক্রমসহ রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই দেশ দুটির অনেক মিল রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনুরূপ প্রয়োগযোগ্য পদক্ষেপ এবং অন্যান্য বিষয় প্রযোজ্য।
করোনা টেস্ট সুবিধা: প্রাথমিকভাবে শুধু ২০ হাজার মানুষের জন্য করোনা পরীক্ষার সুবিধা ছিল দিল্লিতে। পরীক্ষার ফলাফল পেতে চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হতো। ভারত সরকার পরীক্ষার সুবিধা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া তারা একবার একজন ব্যক্তির পজিটিভ ধরা পড়লে তাদের ক্ষেত্রে নো-সেকেন্ড টেস্ট নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ১৪ দিন পর তাকে বিবেচনা করা হয়েছে নেগেটিভ কিংবা কম ক্ষতিকারক হিসেবে। বাংলাদেশও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।
হাসপাতালের শয্যা: দিল্লিতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যার চাহিদা ছয় হাজার ৩২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মে মাসে ২৪ হাজার ১৮-তে উন্নীত হয়েছিল। অর্থাৎ হাসপাতাল শয্যার চাহিদা চার গুণ দাঁড়িয়েছিল। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী অনেক পাবলিক প্লেস যেমন- স্টেডিয়াম, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, মন্দিরে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেছিল। ভারতের মতো বাংলাদেশও একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।
অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা: দিল্লির হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ ছিল দৈনিক ১২০ টন। কিন্তু মহামারির পিক সময়ে এই অক্সিজেনের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে দৈনিক পাঁচ হাজার ৫০ টন হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের সাহায্য নেয়। বিভিন্ন দেশের সহায়তায় তারা ১৭ হাজার ৭৫৫ অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর এবং ১৯টি অক্সিজেন প্লান্ট সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশেরও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আপৎকালীন অক্সিজেন সরবরাহ জোগানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। এখানে আমাদের একটি সমন্বিত অক্সিজেন বিতরণ পরিকল্পনা থাকা দরকার, যাতে সংকট মোকাবিলায় অক্সিজেন বিতরণে অব্যবস্থাপনা এড়ানো সম্ভব হয়।
অপরিহার্য ওষুধ সরবরাহ: দিল্লিতে কভিড-১৯ মহামারির সংক্রমণ চূড়ায় থাকা অবস্থায় জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধ যেমন রেমডিসিভির, ইভারমেকটিন ইত্যাদির চরম ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। ফার্মেসিগুলোতে জরুরি ওষুধ সংকট তৈরি হয়েছিল। অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের বাফার স্টক তৈরির কথা ভাবতে পারে। সেই সঙ্গে ওষুধ বাজারে কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। উপরন্তু আমরা কভিড-১৯-এর চিকিৎসার জন্য মেডিকেল প্রটোকল পরিবর্তন করতে পারি। ওষুধের কালোবাজারি বন্ধ করতে পারি। ভারতও তাই করেছিল।
সময়মতো লকডাউন: দিল্লির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত লকডাউনই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ হ্রাস এবং সংক্রমণ-শৃঙ্খল ভাঙতে সাহায্য করেছে। অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, যদি লকডাউন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জারি করা হতো, তবে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বপরিকল্পনার অনুপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। লকডাউন দেওয়ার আগে কিংবা হঠাৎ কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে যথেষ্ট সময় না দেওয়ার বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে।
টিকাদান কর্মসূচি :দিল্লিতে কভিড-১৯-এর ভয়াবহ সংক্রমণের সময় ভ্যাকসিনের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছিল। যেহেতু চাহিদার অনুপাতে উৎপাদন ও সরবরাহ অপর্যাপ্ত ছিল; এ ক্ষেত্রে বিপর্যয় মোকাবিলায় টিকা সামান্যই ভূমিকা পালন করেছে। অতএব, ভারতীয় কেস স্টাডি থেকে শিক্ষণীয়- পর্যাপ্ত স্টক নিশ্চিত করার মাধ্যমে কভিডের বিস্তার রোধ সম্ভব।
হোল সোসাইটি অ্যাপ্রোচ: করোনা মহামারির বিপর্যয় এড়াতে সবার অংশগ্রহণমূলক ‘হোল সোসাইটি অ্যাপ্রোচ’ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। চিকিৎসার সুব্যবস্থার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টি, ভাইরাসের বিস্তার পর্যবেক্ষণ, সমাজের প্রান্তিক মানুষের সাহায্য করা, দাফন-সামাজিক সহায়তা এবং স্বজন হারানোয় মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, এনজিও, সুশীল সমাজসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
উপর্যুক্ত কেস স্টাডির আলোকে উপসংহার টানা যেতে পারে- ভারত করোনা সংক্রমণের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। উপরন্তু আমাদের জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর এবং অক্সিজেন উৎপাদন প্লান্ট সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কভিড-১৯-এর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধের বাফার স্টক তৈরির পাশাপাশি আমাদের বিপণন ও বিতরণের দিকে নজরদারি থাকা দরকার। সর্বোপরি জীবনযাত্রার সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত সামাজিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।