আবুল খায়ের ছিলেন অদম্য সাহসী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী টগবগে তরুণ। একাধারে সাংবাদিক, নাট্যাভিনেতা, গল্পকার, সংস্কৃতিকর্মী ও এলাকার জনহিতকর নানা কর্মযজ্ঞে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। লাকসাম সিগারেট কারখানায় নিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে বুকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা।
শহীদ আবুল খায়েরের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার কামড্যা গ্রামে। বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসমত উল্লাহ ও মা মাজেদা খাতুন। তিনি ছিলেন পাঁচ ভাই–বোনের মধ্যে বড়। লাকসাম হাইস্কুল থেকে এসএসসি, নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএ পাস করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন।
লাকসাম থেকে ডাকাতিয়া নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন আবুল খায়ের। এ ছাড়া কুমিল্লার ৬৬ বছরের পুরোনো পত্রিকা সাপ্তাহিক আমোদ, দৈনিক আজাদ ও দৈনিক পয়গাম পত্রিকার লাকসাম প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি লাকসাম মিতালী সংঘ ও কামড্যা স্টুডেন্ট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবুল খায়ের ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যান। সেখান থেকে ফিরে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। একাত্তরের ১৬ জুলাই আবুল খায়ের ও তাঁর সঙ্গীরা লাকসাম বাজারের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালান। যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি গুলিতে আহত হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে এলেও রাজাকাররা তাঁকে ধরে লাকসাম শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শহীদ মিয়ার হাতে তুলে দেয়। শহীদ মিয়া তাঁকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করেন। পরে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে লাকসাম সিগারেট কারখানায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
আবুল খায়েরের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহম্মেদ স্মৃতিচারণা করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই আমাদের এলাকা থেকে প্রথম ভারতে ট্রেনিং নেন। পরে লাকসাম এসে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। আমার বাবা মাওলানা ছিলেন। তিনি ২০০৪ ও মা ২০০৯ সালে মারা যান। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁরা বড় ছেলের কথা মনে হলেই কাঁদতেন।’
লাকসামের যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোহর আলী বলেন, ‘আমি আর খায়ের ভাই একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কাঁঠালিয়া এলাকায় যাই। প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। তিনি নির্ভীক বীর যোদ্ধা ছিলেন।’
শহীদ আবুল খায়েরের স্মৃতি রক্ষায় ১৯৭২ সালে কামড্যা গ্রামে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের উচ্চবিদ্যালয়’, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া লাকসামের ইরুয়াইন থেকে কামড্যা পর্যন্ত সড়কের নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের সড়ক’। কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকে তাঁর নাম রয়েছে। এখন তাঁর নামে একটি কলেজ, একটি ফাউন্ডেশন করার কথা ভাবছেন পরিবারের উত্তরসূরিরা।